একবার ভাবুন—ভারত মহাসাগরের মাঝখানে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দুর মতো এক দ্বীপ, যার চায়ের পাহাড়, প্রাচীন মন্দির, ঝরনা আর ঐতিহাসিক দুর্গগুলো আপনাকে ডাকে রূপকথার মতো এক অভিজ্ঞতায়। এটি কোনো স্বপ্ন নয়, এটি শ্রীলঙ্কা।
আর আপনি যদি বাংলাদেশ থেকে এই রূপকথার দেশটি ঘুরে দেখতে চান, তাহলে দরকার শ্রী লংকা ভিসা বাংলাদেশ থেকে আবেদন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে জানা। চলুন, আমি আপনাকে হাত ধরে গাইড করি এই যাত্রায়।
শ্রীলঙ্কা: রূপকথার রাজ্য যেন চোখের সামনে
শ্রীলঙ্কা—একটি দেশ, যার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, এমনকি খাবারেরও রয়েছে গভীর সম্পর্ক। চায়ের দেশ নুওয়ারা এলিয়া, ধর্মীয় কেন্দ্র ক্যান্ডি, ইতিহাসে মোড়া অনুরাধাপুর আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গ অ্যাডামস পিক—সব মিলিয়ে এটি এমন একটি গন্তব্য যা একবার দেখলেই মনের গহীনে গেঁথে যায়।
দেশটি যেন ভ্রমণকারীদের জন্য এক নান্দনিক চিত্রপট, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস, ধর্ম এবং মানুষ মিলেমিশে এক অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
শ্রী লংকা ভিসা বাংলাদেশ থেকে আবেদন: সহজ অনলাইন পদ্ধতি
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করতে গেলে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন (ETA) ভিসা আবশ্যক। সুখবর হলো, এটি আপনি ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন করতে পারেন।
শ্রীলঙ্কা ETA ভিসা আবেদন করার ধাপগুলো:
-
ভিজিট করুন:
https://eta.gov.lk/etaslvisa/etaNavServ?payType=1 -
আবেদন ফর্ম পূরণ করুন:
-
পাসপোর্ট নম্বর
-
ব্যক্তিগত তথ্য
-
যাত্রার তারিখ
-
-
ভিসা ফি পরিশোধ:
-
২০ মার্কিন ডলার (অনলাইনে আবেদন করলে)
-
অর্থাৎ প্রায় ২১৯২ টাকা (১ ডলার = ১০৯.৬১ টাকা হিসেবে)
-
-
আবেদন সাবমিট করার পর অনলাইনে একটি ভিসা স্বীকৃতি পত্র পাবেন। এটি প্রিন্ট করে রাখতে হবে।
-
ভিসা স্ট্যাটাস জানতে:
https://eta.gov.lk/etaslvisa/pages/checkStatus.jsp
মনে রাখবেন: ইটিএ ভিসা প্রাথমিকভাবে ৩০ দিনের জন্য ইস্যু হয়।
শ্রীলঙ্কা প্রবেশের আগে যা যা লাগবে:
অনেকে ভাবেন অনলাইন ভিসা পেলেই সব শেষ! কিন্তু না, শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের সময় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কিছু অতিরিক্ত তথ্য যাচাই করেন।
প্রয়োজনীয়তা:
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট | বিস্তারিত |
---|---|
পাসপোর্টের মেয়াদ | শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর তারিখ থেকে কমপক্ষে ৬ মাস |
ফিরতি টিকিট | নিশ্চিত করা থাকতে হবে |
তহবিল প্রমাণ | পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে |
ETA স্বীকৃতি পত্র | প্রিন্ট করা থাকতে হবে |
এই বিষয়গুলো ঠিকঠাক না থাকলে, এয়ারপোর্টে প্রবেশে সমস্যা হতে পারে। তাই শুরুতেই সাবধান হওয়া ভালো।
ভিসা খরচ ও বিকল্প অপশন
যারা শ্রীলঙ্কা পৌঁছে অনস্পট ভিসা নিতে চান, তাদের জন্য ফি একটু বেশি—২৫ মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৭৪০ টাকা।
১২ বছরের নিচে শিশুদের জন্য কোন ফি লাগে না।
ভিসা ফি আপনি বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শ্রীলঙ্কান রুপিতে পরিশোধ করতে পারেন।
বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার উপায়
দুটি প্রধান পথ:
-
ভারত হয়ে যাওয়ার বিকল্প:
-
সস্তা
-
তবে দরকার ভারতের ট্রানজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসা
-
সময় একটু বেশি লাগে
-
-
সরাসরি কলম্বো ফ্লাইট:
-
খরচ বেশি
-
কিন্তু সময় বাঁচে (মাত্র ৩.৫ ঘণ্টা)
-
ঝামেলা কম
-
সরাসরি প্লেনের খরচ:
খরচের ধরন | আনুমানিক পরিমাণ (USD) | আনুমানিক টাকায় (BDT) |
---|---|---|
ফ্লাইট | ৬৬৯ ডলার | প্রায় ৭৩,৩২৬ টাকা |
সময় | সর্বোচ্চ ৩.৫ ঘণ্টা |
আপনার বাজেট ও সময় বিবেচনায় যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে পারেন।
শ্রীলঙ্কার ৫টি দর্শনীয় স্থান যেগুলো মিস করলে আফসোস হবে
১. নুওয়ারা এলিয়া: শ্রীলঙ্কার মিনি ইংল্যান্ড
চায়ের গন্ধে ভরা এই শহরে:
-
গ্রেগরি লেক
-
লাভারস লিপ ঝরনা
-
সীথা আম্মান মন্দির
-
পেড্রো টি ফ্যাক্টরি
এই শহরটি যেন মেঘ আর সবুজের মধ্যে এক টুকরো ইউরোপ।
২. ক্যান্ডি: বুদ্ধের দাঁত আর পাহাড়ের শহর
শহরটি এসালা পেরাহেরা উৎসব ও টুথ রেলিক টেম্পল এর জন্য বিখ্যাত।
আরও ঘুরে দেখতে পারেন:
-
রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন
-
হানথানা মাউন্টেন
-
আম্বুলুয়াওয়া টাওয়ার
পাহাড়ি দৃশ্য, মিষ্টি হাওয়া আর শান্ত পরিবেশ ক্যান্ডিকে এক অনন্য অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।
৩. সিগিরিয়া: প্রাচীন দুর্গ ও আয়নার দেয়াল
২০০ কোটি বছর পুরনো এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে আপনি পাবেন:
-
সিগিরিয়া রক ফোর্ট
-
ফ্রেস্কো দেয়াল
-
মিননেরিয়া ন্যাশনাল পার্ক
ইতিহাস আর প্রকৃতির মিশেলে এক অনন্য জায়গা।
৪. অনুরাধাপুর: ধর্ম ও ইতিহাসের মিলনস্থল
প্রাচীন শহরটি বিখ্যাত:
-
আট মহাস্থাপনা
-
শ্রী মহাবোধি
-
রুয়ানওয়েলি মহাসায়া
-
আওকনা বুদ্ধ মূর্তি (৪২ ফুট উঁচু)
এই স্থানগুলো যেন অতীতের স্পর্শ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানের মাঝে।
৫. অ্যাডামস পিক: পবিত্রতা ও অ্যাডভেঞ্চার একসঙ্গে
৭ হাজার ৩৫৯ ফুট উঁচু এই পাহাড়ে:
-
রয়েছে পাথরের উপর পায়ের ছাপ
-
সব ধর্মের মানুষের কাছে পবিত্র
-
রয়েছে ৬টি ট্রেইল
সবচেয়ে জনপ্রিয় পথ: হ্যাটন – নাল্লাথান্নি।
থাকা ও খাওয়ার ব্যয়
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে গেলে খরচ কেমন হয়? চলুন দেখে নিই:
হোটেল খরচ (দুইজনের জন্য):
হোটেলের মান | শ্রীলঙ্কান রুপি | বাংলাদেশি টাকা |
---|---|---|
বাজেট | ৫১৫৮ | প্রায় ১৮৮৫ টাকা |
মিডরেঞ্জ | ১৪৭৭১ | প্রায় ৫৩৯৭ টাকা |
খাবার খরচ:
প্রতিদিনের খরচ | শ্রীলঙ্কান রুপি | বাংলাদেশি টাকা |
---|---|---|
জনপ্রতি | ১৮৫০–৪৮৭৯ | ৬৭৬–১৭৮৩ টাকা |
পরিবহন খরচ:
প্রতিদিনের খরচ | শ্রীলঙ্কান রুপি | বাংলাদেশি টাকা |
---|---|---|
জনপ্রতি | ৫৪৪–১৫১৫ | ১৯৯–৫৫৪ টাকা |
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের সতর্কতা: নিরাপদ অভিজ্ঞতার চাবিকাঠি
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি কিছু সতর্কতা না মানলে অভিজ্ঞতা বিঘ্নিতও হতে পারে।
খুচরা টাকা রাখা জরুরি
স্থানীয় যানবাহনে কিংবা ছোট দোকানে অনেক সময় বড় নোট নেয় না। তাই ২০, ৫০ কিংবা ১০০ রুপির খুচরা নোট পকেটে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
ধর্মীয় স্থান ভ্রমণে শিষ্টাচার
-
মন্দির বা প্যাগোডায় প্রবেশের আগে জুতা খুলে ফেলতে হয়।
-
কিছু জায়গায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ—সেজন্য আগে অনুমতি নেওয়া ভালো।
-
ছবি তুলতে হলে স্থানীয়দের সম্মতি নিন।
টুকটুক চালকদের সাবধানতা
অনেক চালক পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে চায়। তাই ভালো হয় উবার বা পিকমি অ্যাপ ব্যবহার করলে।
মশার তাণ্ডব
শ্রীলঙ্কায় বিশেষ করে ভোর আর সন্ধ্যায় মশার উপদ্রব বেশি। তাই নিয়ে যান মশা নিরোধক ক্রিম বা স্প্রে, যার মধ্যে DEET থাকে।
মানসিক প্রস্তুতি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা: রোমাঞ্চ ও বাস্তবতার সংমিশ্রণ
আমাদের অনেকের ধারণা ভ্রমণ মানেই শুধুই মজা। কিন্তু বিদেশে গিয়ে ছোট একটি ভুলও বড় বিপদের কারণ হতে পারে। তাই “শ্রী লংকা ভিসা বাংলাদেশ থেকে আবেদন” এর পরবর্তী ধাপগুলোও বাস্তবিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
আপনি যখন শ্রীলঙ্কায় পৌঁছাবেন:
-
ভাষা একটি বাধা হতে পারে, যদিও বেশিরভাগ পর্যটন এলাকায় ইংরেজি চলে।
-
কিছু কিছু জায়গায় ইন্টারনেট স্লো, তাই অফলাইন ম্যাপ ডাউনলোড করে রাখুন।
-
হোটেল বুকিং আগে থেকেই অনলাইনে করলে ঝামেলা কমে।
শুধু চোখে দেখা নয়—শ্রীলঙ্কার গন্ধ, স্বাদ, শব্দ—সবকিছু মিলে এক ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা তৈরি করে। সিগিরিয়ার পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে আপনি বুঝবেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সীমানা কত বিশাল হতে পারে।
লোকাল অ্যাপ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার আপনার ভ্রমণকে আরও সহজ ও আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে।
প্রয়োজনীয় অ্যাপ:
-
Uber/PickMe: লোকাল ট্রান্সপোর্টের জন্য
-
Booking.com/Airbnb: হোটেল বুকিং
-
Google Translate: ভাষার সমস্যার সমাধান
-
XE Currency: ভ্রমণের খরচ রূপান্তরের জন্য
এছাড়াও শ্রীলঙ্কার রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে চাইলে “Sri Lanka Railways Time Table” অ্যাপটি দারুণ সহায়ক।
সময় ও খরচের পরিকল্পনা: সাশ্রয়ী কিন্তু স্মার্ট ভ্রমণ
শ্রীলঙ্কা যত ছোট মনে হয়, ঘুরে দেখার জন্য সময় আর বাজেট দুই-ই লাগে। তাই আগে থেকেই প্ল্যান করে নেয়া ভালো।
৭ দিনের একটি সাধারন প্ল্যান (২ জনের জন্য):
বিষয় | আনুমানিক খরচ (LKR) | আনুমানিক টাকায় (BDT) |
---|---|---|
হোটেল ভাড়া | ৫১৫৮–১৪৭৭১ | ১৮৮৫–৫৩৯৭ টাকা |
খাবার | ২৫৯০০–৩৪০০০ | ৯৪৭০–১২৪৩০ টাকা |
ট্রান্সপোর্ট | ৭৬০০–১০৬০০ | ২৭৮০–৩৮৮০ টাকা |
ভিসা + প্লেন টিকিট | ৮০,০০০+ | (প্রায়) ৭৫,০০০+ টাকা |
সব মিলিয়ে ৭ দিন ঘুরতে গেলে দুজনের খরচ প্রায় ৭৮,০০০ থেকে ৯০,০০০ টাকার মতো হতে পারে।
এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখুন: আপনি যত কম জায়গা ঘুরবেন, তত বেশি সময় পাবেন একটি স্থান ভালোভাবে উপভোগ করতে।
ভ্রমণ প্রস্তুতির চেকলিস্ট
আপনি যদি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেন, তাহলে নিচের চেকলিস্টটি খুব কাজে দেবে:
-
পাসপোর্ট (মেয়াদ ৬ মাসের বেশি)
-
ETA ভিসা প্রিন্ট কপি
-
ফিরতি টিকিট
-
হোটেল বুকিং প্রমাণপত্র
-
প্রয়োজনীয় খুচরা টাকা
-
হালকা ও আরামদায়ক জামাকাপড়
-
মোবাইল চার্জার ও পাওয়ার ব্যাংক
-
মশা নিরোধক স্প্রে
-
ওষুধের একটি ছোট মেডিকেল কিট
-
লোকাল সিম অথবা ইন্টারন্যাশনাল রোমিং
শেষ কথা: অভিজ্ঞতা, না শুধুই ঘুরে দেখা?
একটা দেশকে শুধু চোখে দেখা যায় না, অনুভবও করতে হয়। আর শ্রীলঙ্কা এমন একটি দেশ যেখানে আপনি শুধু দৃশ্য দেখবেন না, আপনি শ্রদ্ধা, সংস্কৃতি, স্বাদ—সবকিছুকে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন।
“শ্রী লংকা ভিসা বাংলাদেশ থেকে আবেদন” এখন আর কোনো জটিলতা নয়, বরং এক ক্লিকের দূরত্বে। তবে ভিসা পাওয়ার পর সত্যিকারের অভিজ্ঞতা শুরু হয় শ্রীলঙ্কার মাটিতে পা রাখার পর।
জীবনের নানা ক্লান্তি, একঘেয়েমি, কিংবা আত্মার টান—শ্রীলঙ্কা এক অনন্য গন্তব্য যা প্রতিটি বাংলাদেশির একবার হলেও দেখা উচিত। চোখে জল এনে দেওয়া সূর্যাস্ত, পাথরে কাটা পায়ের ছাপ, বা পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির দল—সবকিছু মিলে শ্রীলঙ্কা আপনাকে নতুন করে জীবনকে ভালোবাসতে শিখাবে।
শেষবারের মতো মনে রাখবেন:
“শ্রী লংকা ভিসা বাংলাদেশ থেকে আবেদন” একটি সরল কিন্তু সঠিকভাবে পূরণযোগ্য প্রক্রিয়া। যদি সবকিছু সঠিকভাবে প্রস্তুত করেন, তাহলে এই যাত্রা হবে আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।